Type Here to Get Search Results !

সাহিত্য সামগ্রী ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) | সাহিত্য সামগ্রী প্রবন্ধ সাজেশন ২০২২ | Sahitto samogri probondho Suggestion 2022


সাহিত্য সামগ্রী প্রবন্ধ ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) | সাহিত্য সামগ্রী প্রবন্ধ প্রশ্ন ও উত্তর | অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর | সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর | ফার্স্ট সেমিস্টার বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য সামগ্রী সাজেশন ২০২২


১। সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধটির রচনাকাল উল্লেখ করো।

উঃ 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধটির রচনাকাল কার্তিক, ১৩১০ বঙ্গাব্দ । 

২। 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধটি কোন্ পত্রিকায় কবে প্রকাশিত হয়?

উ: ‘সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধটি 'নবপর্যায় বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় কার্তিক ১৩১০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।

৩। নব পৰ্যায় বাদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের নাম কী?

উঃ নবপর্যায় বাগদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

৪। 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধটি কোন্ প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত?

উ: সাহিত্যের সামগ্রী প্রবন্ধটি 'সাহিত্য' প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত।

৫। 'সাহিত্য প্রবন্ধ' গ্রন্থটির প্রকাশক কে? এই গ্রন্থটির প্রকাশকাল উল্লেখ করো।

উ: ‘সাহিত্য প্রবন্ধ' গ্রন্থটির প্রকাশক ছিলেন মজুমদার লাইব্রেরির পক্ষে সুহাসচন্দ্র মজুমদার। এই গ্রন্থটির প্রকাশকাল ভাদ্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দ বা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ।

৬। সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থটি কাকে উৎসর্গ করা হয়েছিল? 

উ: সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থটি বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।

৭। সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থের কবির জীবতকালে কটা প্রবন্ধ স্থান পেয়েছিল ?

উ: সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থের কবির জীবতকালে ১১টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছিল। 

৮। সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রথম ও শেষ প্রবন্ধের নাম প্রকাশকাল সহ উল্লেখ করো। 

উ: সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের নাম সাহিত্যের তাৎপর্য, "নবপর্যায়' বা পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩১০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। শেষ প্ৰবন্ধ 'কবি জীবনী' নবপর্যায় বাদর্শন আষাঢ় ১৩০৮ বলাশে। 


৯। সাহিত্যের সামগ্রী প্রকল্পটির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রকল্পটির নাম প্রকাশ করো প্রকাশকাল সহ

উ: সাহিত্যের সামগ্রী প্রবন্ধটির পূর্ববর্তী প্রবন্ধ 'সাহিত্যের তাৎপর্য' অগ্রহায়ণ ১৩১০ সল্যান্ড পরবর্তী প্রবন্ধ সাহিত্যের বিচারক আশ্বিন ১৩১০ বঙ্গাব্দে। 

১০। সাহিত্যের সামগ্রী প্রবন্ধে মূলত রবীন্দ্রনাথ কী বলতে চেয়েছেন?

উ: সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন কী এবং সাহিত্যিক তাঁর সৃষ্টিকে কীভাবে অমর করে তোলেন,

১১। রবীন্দ্রনাথের মতে সাহিত্য কী?

প্রাবন্ধিক এই প্রবন্ধে তা আলোচনা করেছেন। উঃ রবীন্দ্রনাথের মতে সাহিত্য কেবল নিজের মানের আনন্দ প্রকাশের জন্য রচিত নয়; সাহিত্যিকের সাহিত্য রচনার প্রধান লক্ষ্য হল পাঠক সমাজ।

১২। প্রকাশই সাহিত্যের প্রধান ধর্ম – এটি কোন প্রবন্ধের অন্তর্গত লাইন? তিনি কেন এই কথা বলেছেন ?

উ: উপারি উদ্ধৃত লাইনটি 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধের অন্তর্গত। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে কেবল নিজের জন্য সতি করে রেখে দেন না—তাকে সকলের আনন্দ বিধানের জন্য তুলে ধরেন। সৃষ্টির প্রধান ধর্মইতো প্রকাশ করা, তাই তিনি এই কথা বলেছেন।

১৩। সাহিত্য সৃষ্টির সার্থকতা কোথায় ?

উ: সাহিত্য সৃষ্টি কেবল রচয়িতার জন্য নয়- রচয়িতা তাঁর রচনাকে যুগ-যুগান্তরের সকলের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দেন; তবেই তার রচনার সার্থকতা। 

১৪। মানব মনের স্বাভাবিক প্রবণতা কী ?

উ: মানব-মনের স্বাভাবিক প্রবণতা হল – সকলের মনের মধ্যে মানুষের ভাবনা ব্যাপ্ত করে সকলের মধ্যে অনুভূতি জাগিয়ে আনন্দের সপ্তার করা।

১৫। সাহিত্যের সামগ্রী প্রবন্ধে দুটি ইতিহাসের ঘটনা উল্লেখ করো।

উ: সাহিত্যের সামগ্রী প্রবন্ধে দুটি ইতিহাসের ঘটনা হল—(ক) মধ্য এশিয়ায় গোবি মরুভূমির বালুকাস্তূপের কথা আছে। (খ) সম্রাট অশোকের প্রসঙ্গ আছে, সেই সলো পাটলিপুত্রের কথা বর্ণিত হয়েছে।

১৬। মানুষের সৃষ্টি করা প্রকার ও কী কী?

উ: মানুষের সৃষ্টি দুই প্রকারের। একটি চিরকালীন, অপরটি সমকালীন। ক্ষণকালনী সৃষ্টি কেবল প্রয়োজন মেটায়; চিরকালীন সৃষ্টি প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে চিরস্থায়িত্বের অমরতা আনে। 

১৭। 'কেহ তাহার ইশারায় সাড়া দিল না।'—কোন প্রবন্ধের অংশ। এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে?

উ: 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধের অংশ। এখানে প্রাবন্ধিক বলেছেন রাজপুত গেল, পাঠান গেল মোডাল গেল, বর্গির তরবারি বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্রবেশে দিক দিগন্তে প্রলয়ের কষাঘাত করে গেল। কেউই তার ঈশারায় সাড়া দিল না।

১৮। 'জ্ঞানের কথা একবার জানিলে আর জানিতে হয় না'—এখানে কেন এই কথা বলেছে? 

উ: আসলে জ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলেই তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। আগুন গরম, সূর্য গেলে, জল তরল প্রভৃতি সম্বন্ধে একবার জ্ঞানলাভ করার পর তা নতুন করে জানার প্রয়োজন হয় না। 

১৯। 'কিন্তু ভাবের কথা বারবার অনুভব করিয়া শাস্তি রোধ হয় না - প্রাবন্ধিকের এই কথা বলার কারণ কী?

উঃ ভাব হল বিষয়ের ক্ষেত্রে অন্য ব্যাপার তা অনুভূতির জিনিস। ভাবের কথাকে অপরের অনুভূতিতে সঞ্চারিত করে দিতে হয়, সেখানে প্রমাণ, তত্ত্ব, যুক্তি, তর্ক, প্রভৃতির অপেক্ষা রাখে না। এই অনুভূতির লোকপরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে আসে, সেই জন্যই বার বার অনুভব করে শাস্তি পাওয়া যায় না। 


২০। কিন্তু রচনা লেখকের সম্পূর্ণ নিজের। - প্রাবন্ধিক কেন রচনাকে সম্পূর্ণ নিজের বলেছেন? 

উ: আসলে ভাব, বিষয়, তত্ত্ব সাধারণ মানুষের। তা একজন যদি বের না করে তা কোনো এক সময় অন্য একজন বের করবে। কিন্তু কবি তা সাহিত্যিকের সৃষ্টিটি সম্পূর্ণ নিজের। সেটা একজনের যেমন হবে। আরেক জনের তেমন হবে না। সেই জন্যই লেখক তাঁর রচনাকে সম্পূর্ণ নিজের বলেছেন।

২১। সাহিত্যের সামগ্রী' বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝিয়েছেন ? 

উ: সাহিত্যের সামগ্রী বলতে প্রাবন্ধিক বুঝিয়েছেন—“যে সকল জিনিস অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হইবার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর রং ইঙ্গিত প্রার্থনা করে, যাহা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্ট না হইয়া উঠিলে অন্য হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না, তাহাই সাহিত্যের সামগ্রী।


সাহিত্য সামগ্রী প্রবন্ধ ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) | সাহিত্য সামগ্রী প্রবন্ধ প্রশ্ন ও উত্তর | রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর | বড় প্রশ্নোত্তর |মধ্যম মানের প্রশ্নোত্তর | ফার্স্ট সেমিস্টার বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য সামগ্রী সাজেশন ২০২২


১। সাহিত্যের সামগ্রীর বিষয়গুলি আলোচনা করো।

উত্তর : সাহিত্য মূলতঃ রসধর্মী; বিজ্ঞানের মতো বিশ্লেষণ বা তথ্য জিজ্ঞাসা সাহিত্যের কাজ নয়, তথ্য সন্ধান, তত্ত্ব জিজ্ঞাসা, বা কোনো মনস্তাত্ত্বিক সীমান্তের প্রতিপাদন সাহিত্যের কাজ নয়। সাহিত্য যে জ্ঞানের বিষয় নয় ভাবের বিষয় সেইটি বোঝাতে এই প্রবন্ধের অবতারণা।

সাহিত্যের সামগ্রীর বিচারে বস্তুজগতের কথা প্রথম মনে আসে। রবীন্দ্রনাথ বস্তুজগতের সুন্দর একটি উপমার সাহায্যে বিষয়টিকে প্রত্যক্ষ করে তুলেছেন – যে কাঠ জ্বলে নাই তাহাকে আগুন নাম দেওয়াও যেমন, যে মানুষ আকাশের দিকে তাকাইয়া আকাশেরই মতো নীরব হইয়া থাকে তাহাকেও কবি বলা সেইরূপ।” অর্থাৎ কার মনের মধ্যে কী আছে তা প্রকাশিত না হলে অন্যের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। অথচ সাহিত্যিকরা সেই জগতেরই সন্ধান দেন, মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বার বাইরে সে দৃশ্য ও অদৃশ্য জগৎ যে অনিবর্তনীয় রূপ-মাধুর্য নিয়ে বিরাজ করছে তাকেই আমরা বস্তু-জ বলে মনে করি। মানুষের সুখ-দুঃখের আয়ত্বের বাইরে প্রকৃতি। মানবজীবন এবং অদৃশ্য শক্তি অবিরত ও প্রাণচাঞ্চল্য প্রকাশ করে চলেছে, সাহিত্যের সামগ্রী রূপে সেগুলিকে আমরা গ্রহণ করি। এ কথায় মানবজীবন বিশ্বপ্রকৃতি পরিদৃশ্যমান জগৎ এবং তারই অন্তরালবর্তী জীবনের নিয়ন্তারূপ সত্ত্বা প্রভৃতি মিলে সাহিত্যের সামগ্রী গড়ে তোলে।


২। প্রকাশই কবিত্ব-ব্যাখ্যা করো।

উত্তর :  সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে 'সহিদ' শব্দ থেকে সাহিত্য কথাটি এসেছে। তাই সাহিত্য কথাটিতে একটি মিলনের ভাব দেখা যায়—যেটা কেবল ভাবে ভাবে, ভাষায় ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন নয়; মানুষের সঙ্গ্যে মানুষের, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, দূরের সঙ্গে নিকটের, বহির্বস্তুর সঙ্গে হৃদয়ের মিলন। অর্থাৎ কবি কেবলমাত্র তার নিজের আনন্দের জন্য কাব্য রচনা করেন না, কবির উদ্দেশ্য হল পাঠকের হৃদয়ে আনন্দ দান করা। পাঠকের হৃদয়ে আনন্দ দান করার মধ্যেই কাব্যের সার্থকতা লুকিয়ে আছে। লৌকিক জগতে থাকে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, কাব্যের জগতে কবি সেই লৌকিক জগতের ঘৃণার বস্তুকে তাঁর অপূর্ব নির্মাণক্ষম শক্তির সাহায্যে কাব্যের জগতে ফুটিয়ে তোলেন—কাব্যের পাঠক তাকে সাদরে বরণ করে। সেই জনাই প্রকাশের মধ্যেই কাব্যের চরম সার্থকতা প্রকাশ পায়। সেটাকেই প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ বলেছেন প্রকাশই কবিত্ব ।

৩। সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের বিষয় নহে, ভাবের বিষয়।” আলোচনা করো।

উত্তর : সাহিত্য কেবল জ্ঞানের কথার সামগ্রী নয়। জ্ঞানের বিষয়ের মধ্যে জীবনরস সপ্তার করে কল্পনায় তাকে বাস্তবসম্মত করে তোলার মধ্যেই সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র নিহিত। জ্ঞানের বিষয় জানা মাত্রই সব আকর্ষন ফুরিয়ে যায়। দ্বিতীয়বার তার আর জানার আকর্ষণ থাকে না। আগুন গরম, সূর্য গোল, পাথর কঠিন, জল তরল—এগুলি তো জ্ঞানের কথা, তবে তাই নয় এইগুলি পুরাতন বিষয় বটে। তাই একবার জানা হয়ে গেলে বিষয় পুরাতন হয়ে যায়। সাহিত্যে ভাবের কথা: ভাবের বিষয় কখনও পুরাতন হয় না। শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসে দেবদাসের জীবন ট্র্যাজেডি আজ সমানভাবে জনপ্রিয়, যেহেতু সাহিত্য ভাবের কথা বলে। তাই এই ভাবের বিষয় কখনও পুরাতন হয় না। নিতা নতুন ৰূপে তা মনকে উদ্ভাসিত করে তোলে তার চিরন্তন। ভাবের প্রকাশ চিরন্তন; তাই ভাবের প্রকাশের বাহন যে সাহিত্য তাও চিরন্তন। এ প্রসঙ্গ্যে কালীদাসের মেঘদূত কাব্যের কথা খুব মনে পড়ে। কালীদাস বিরহী যক্ষের হৃদয়ভাবের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা তো কোনো বিশেষ ব্যক্তি, বিশেষ কালের হদয়ভাব নয়, তা হল বিশ্বের সকল বিরহী মনের। সেকালের বিরহী যক্ষ একালে ও বিরহীমনের নবরূপ লাভ করেছে। সাহিত্যে তাই সেই ভাবের ব্যক্ত করে বলেই তা আজও চিরন্তন।


৪। ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহা সাহিত্য, ইহা ললিতকলা।”- তাৎপর্য উল্লেখ করো। 

উত্তর : কবি ও সাহিত্যক কলাকৌশল পূর্ণ রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের ভাবনায় দেহ সৃষ্টি করেন। এক-একজন সাহিত্যিক তার নিজের মতো করে কলা-কৌশল সৃষ্টির দ্বারা সাহিত্য গড়ে তোলে। এই কলা-কৌশলকে আলঙ্কারিকরা বলেছেন অলৌকিক মায়ার জগৎ। অলৌকিক কথার সাধারণ অর্থ হল যা লৌকিক নয়। তাহলে কি আমরা অলৌকিক বলতে অতি প্রাকৃত জগৎ বুঝব? তাe নয়। সাধারণের চোখে দেখা যে জগৎ আর কবির চোখে দেখা জগৎ এই দুই জগতের মধ্যে পার্থক্য আছে। কবির চোখে দেখা জগৎ এখানে অলৌকিক জগৎ। এই জগৎকে নিয়ে তার প্রতিভাবলে অর্থাৎ অপূর্ব বস্তু নির্মাণক্ষম প্রতিভার সাহায্যে যা সৃষ্টি হয় সেটিই সাহিত্য। সাহিত্যের মধ্যে লেখক নিজেকে অমর করে রাখেন। ভাবের সন্ধ্যে ভাবপ্রকাশের উপায় সম্মিলিতভাবে সম্মিলিত ভাবেই বোঝায় সাহিত্য। তার সকলের, ভাব প্রকাশের উপায়টি কিন্তু লেখকের। এই দুইকেই অবলম্বন করে সাহিত্যের সৃষ্টি। কবি ও সাহিত্যিক ভাবকে সকলের অন্তরের সামগ্রী করে তোলেন তার প্রকাশভঙ্গির অনবদ্যতায় তাই নিজের ভাবকে সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করে তোলাই সাহিত্যের প্রধান কথা। তাই রবীন্দ্রনাথ উপরিউক্ত কথাটি বলেছেন।


৫। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য গ্রন্থটি কবে প্রকাশিত হয়। তাঁর আরও দুটি সাহিত্য মূলক গ্রন্থের নাম লেখো।

উত্তর : রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্য' গদ্যগ্রন্থাবলীর চতুর্থ অংশরূপে ১৩১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মূল প্রবন্ধগুলির অতিরিক্ত চোদ্দটি প্রবন্ধ ১৩৬১ ব্যাঙ্গ প্রকাশিত সংস্করণে সংযোজনরূপে সংকলিত হয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য তত্ত্বমূলক আরও দুটি গ্রন্থ হল 'সাহিত্যের পথে' ও 'সাহিত্যের স্বরূপ'। 'সাহিত্যের পথে' গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। সাহিত্যের স্বরূপ প্রশ্নটি কবির মৃত্যুর পর ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও 'সমালোচনা', 'প্রাচীন সাহিত্য', 'আধুনিক সাহিত্য', 'লোকসাহিত্য', 'বাংলাভাষা পরিচয়" ইত্যাদি গ্রন্থগুলিকেও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যতত্ত্বমূলক গ্রন্থ বলে উল্লেখ করা যায়। 


২। 'সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের বিষয় নহে' ভাবের বিষয়।

অথবা, "জ্ঞানের কথাকে প্রমাণ করিতে হয়, ভাবের কথাকে সঞ্চার করিতে হয়।" অথবা, “ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা, ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা আলোচনা করো।

উত্তর : উপস্থিত প্রসঙ্গটির বিশদ আলোচনায় অবতীর্ণ হওয়ার আগে আমরা মনে করি, প্রথমেই আমাদের খুব পরিষ্কারভাবে স্পষ্টাস্পটি বুঝে রাখা দরকার, 'জ্ঞানের বিষয়' এবং 'ভাবের বিষয়' বলতে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে ঠিক কোন কথাটি আমাদের বলতে বা বোঝাতে চেয়েছেন? কারণ এ দুটি বিষয়ের ধারণা আমাদের কাছে একেবারে স্বার্থহীনভাবে স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আর্ট ও সাহিত্যের মূল চরিত্র আর বৈশিষ্ট্যটাই সম্ভবতঃ আমাদের বোধের কাছে অত্যন্ত অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে হয়ে থেকে যাবে। ফলে সমগ্রভাবে শুধু সাহিত্য বা আর্ট সম্বন্ধেই না, স্বয়ং বরীন্দ্রনাথের অপরাপর সময়ের সাহিত্য বিষয়ক অনেক বক্তব্যও হয়তো আমাদের কাছে তেমন সুসম্বন্ধ বা যুক্তি-সুষম বলে মনে হবে না।

প্রশ্ন হতে পারে, প্রশ্নের সঙ্গে গর্জমান প্রতিবাদও তর্জন করে উঠতে পারে, কেন, শব্দ দুটির যথেষ্ট স্পষ্ট ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ নিজেই কি তাঁর বক্তব্যের মধ্যে করে দেননি ? তিনি কি একাধিক দৃষ্টান্ত সহ সবিস্তারে বলেননি যে জ্ঞানের বিষয় প্রমাণ করতে হয়, আর ভাবের বিষয়কে করতে হয় সঞ্চার ? তিনি কি জানাননি যে জ্ঞানের বিষয় একবার জানলেই সব কিছু চুকেবুকে গেল, কিন্তু ভাবের বিষয় বারবার গোচরীভূত হলেও তার আবেদন আমাদের কাছে কখনো পুরোনো হয় না। ভাবের বিষয় ভাষান্তরিত করা যায় না, কিন্তু জ্ঞানের বিষয় যায়- ব্যাস, কথা তো এই এই কি যথেষ্ট নয় ? জ্ঞান আর ভাবের বিষয় সম্বন্ধে এরপরও আবার জানায় বা বোঝবার কী বাকি রইল ? সে প্রতিবাদের জবাবে, এ তরফের ঘোষণা বাকি রইল, এরপরও জ্ঞান আর ভাবের বিষয় সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানতে বাকি রইল। কথাটা এই কারণেই একেবারে গোড়াতেই পাড়া হয়েছে। যেমন জানতে বাকি রইল, আমাদের প্রাচীন অলংকার শাস্ত্র যে কবি আর ঋষিদের সমার্থক বলে ঘোষণা করেছেন, সেটা তা হলে কী ব্যাপার ? আমাদের ঋষিরা কি তবে কেবল ভাবের কথাই, অর্থাৎ সাধারণ ভাবে যে মানস-ব্যাপারটিকে আমরা feeling বা অনুভূতি কি হৃদয়াকো নামে অভিহিত করে থাকি তার কথাই প্রচার করে আমাদের নমস্য হয়েছেন? শুধু কি এই কারণেই তাঁদের সঙ্গে কবিদের একাসনে বসানো হয়েছে ?

তেমনই জানতে বাকি রইল, আমাদের রবীন্দ্র-সাহিত্য-বিশেষজ্ঞরা যে প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, রবীন্দ্রনাথ যত বড় কবি, তিনি তত বড়ই দার্শনিক। বস্তুতঃ তাঁর সমস্ত কাব্যই, তাঁর চিন্তাধারা প্রধানতঃ উপনিষদের আলোকেই উদ্ভাসিত হয়েছে এ সিদ্ধান্ত উচ্চ বিশেষজ্ঞগণ তাহলে কী বুঝে করেছেন ? দর্শন এবং উপনিষদের বক্তব্যগুলি কি তবে শুধু ভাবেরই বিষয় ? এর মধ্যে জ্ঞান ট্যানের কোনো কথাই নেই।

এ সম্বন্ধে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত সমালোচকের নীচের এই একটি উদ্ধৃতিও বোধ করি আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে আরও জোরদার বলে গ্রাহ্য হবে “ফরাসী দার্শনিক অঁরি লুই কোর্স (১৮৫৯-১৯৪১)-এর Elan Vital বা ক্রমবিকাশশীল গতিতত্ত্ব ইউরোপের দার্শনিক ও শিল্পীমহলে বিশেষ প্রচার লাভ করেছিল। এই দার্শনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদে স্থিতিকে, জড়ত্বকে নস্যাৎ করে গতিবাদের জয় ঘোষণা করা হয়েছে। থেমে থাকা মিথ্যা, বিরতির নাম মৃত্যু, সত্যের সংজ্ঞা হল অধিকারী ও অপরিণামী গতি। গতিবাদের এই বুদ্ধিগ্রাহ্য তত্ত্ব এ-কাব্যে (অর্থাৎ বলাকা-য়) হৃদয়বেনা রসানুভূতিতে পরিণত হল, দর্শনের গতিবাদ হল কাব্যের গতিরাগ" অর্থাৎ কেবল দর্শনের বিষয়ও নয়, রীতিমতো বুদ্ধিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বও সাহিত্যের বিষয় হতে পারে, এবং সেই তত্ত্বকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থে আত্মীকৃত করেছেন। বস্তুতঃ 'জ্ঞানের বিষয় সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না—এই কথাটিকে নিছক আক্ষরিক অর্থে সাহিত্যের চরম পরিচয় বলে মেনে নিতে গেলে সাহিত্যতত্ত্বের অনেক বক্তব্যই বোধ করি আমাদের অতিশয় গোলমেলে মনে হবে। গোলমেলে মনে হবে যখন আমরা ইংরেজি সাহিত্যের একজন প্রগাঢ় পণ্ডিত ও সমালোচকের মুখে শুনবো 'Now in literature I will limit myself to literature, for it is about literature that the question arises the elements with which the creative power works are ideas; the best ideas, on every matter which literature touches, current at that time; at any rate we may lay it down that in modern literature no manifestation of the creative power not working with these can be very important or fruitful. " [Mathew Arnold, 'Essays in criticism"]

—অর্থাৎ সমকালের সমাজে যে তত্ত্বগুলি চালু থাকে তার যে-কোনো একটাকে সাহিত্যকার যদি তাঁর সৃজনী শক্তির দ্বারা আমাদের উপলব্ধিগোচর না করতে পারেন, তাহলে তার রচনা তেমন সার্থক বা প্রণিধানযোগ্য বলেই বিবেচিত হতে পারে না। একেবারে ষোলো আনা বিপরীত প্রকারের দাবি। তত্ত্ব অর্থাৎ জ্ঞানের বিষয়কে সাহিত্যের সামগ্রী না করতে পারলে, সে রচনা 'সাহিত্য' পদবাচ্যই নয় তাছাড়া, অতদূরেই বা যাবার কী দরকার ? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই যখন আবার বলেন, 'It is for the artist to remind the world that with the truth of our expression we grow in truth. It is for the artist to proclaim his faith in the everlasting 'yes' to say, I believe that there is an ideal hovering over and permeating the earth, an ideal which is not the mere outcome of fancy, but the ultimate reality in which all things dwell and move." তখন তাঁর এই উক্তিও তো প্রায় ম্যাধ্য আর্নল্ডের উপরোক্ত দাবির প্রতিধ্বনি বলেই মনে হয়। উপরন্তু যে টুথকে নৈর্ব্যক্তিক বলে তিনি 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধে সাহিত্য থেকে একেবারেই বাদ দেবার প্রস্তাব করেছেন, সত্য উদ্ধৃত উক্তিতে তো সেই টুথকেই তিনি বলেছেন আর্টিস্টের পক্ষে পরম প্রতিপাদ্য।

তাহলে, শেষ পর্যন্ত কথাটা কী দাঁড়ালো? 'জ্ঞানের বিষয় সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না রবীন্দ্রনাথের এই সিদ্ধান্ত কি তবে যথার্থ নয়? একথা বলার ধৃষ্টতা বোধ হয় পাগলেরও হবে না। আসলে 'জ্ঞান' বলতে রবীন্দ্রনাথ যে-কোনো জ্ঞানের কথাই বলেননি। বা সর্বপ্রকার জ্ঞানের কথাও বলেননি। বঙ্গীয় শব্দকোষে 'জ্ঞান' শব্দের অন্ততঃ পঁচিশটি বিভিন্ন অর্থ সন্নিবেশিত হয়েছে। 'জ্ঞান' শব্দটি তিনি উপস্থিত প্রসঙ্গে প্রযোগ করেছেন জ্ঞানেরই একটি বিশেষ প্রকার সম্পর্কে—যেটাকে সচরাচর আমরা সায়েন্স বা বিজ্ঞান অর্থাৎ বস্তুপদার্থের প্রামাণ্য জ্ঞান নাম দিয়ে থাকি। আর এই সায়েন্স কেন যে সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না, সেকথার নিঃসংশয় ব্যাখ্যা আমরা পাবো শ্রদ্ধেয় প্রমথ চৌধুরীর কাছে “বিজ্ঞান শুধু এক প্রকার বিশেষ জ্ঞানের নাম নয় একটি বিশেষ প্রণালী অবলম্বন করে যে জ্ঞান লাভ করা যায় আসলে তারই নাম বিজ্ঞান .... “সৃষ্টিকে বিকার হিসাবে দেখা কিছু আশ্চর্য নয়, কেননা আপাতসুলভ জ্ঞানে এ বিশ্ব একটি ভাঙাচোরা ছাড়ানো ও ছড়ানো ব্যাপার। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই অসংখ্য পৃথক-পৃথক বস্তুর পরস্পরের সম্বন্ধ নির্ণয় করা, জড়জগতের ভগ্নাংশগুলিকে যোগ দিয়ে একটি মন দিয়ে ধরবার ছোঁবার মত সমষ্টি গড়ে তোলা। এই ভঙ্গাংশগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যোগ করতে হলে আঁকজোক চাই। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার করার নামই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বিজ্ঞানের কারবার শুধু বস্তুর সংখ্যা নিয়ে নয়, পরিমাণ নিয়েও। সুতরাং জীবনের মাপজোখ করাও চাই। বিনা মাপে বিনা আঁকে যে সত্য পাওয়া যায় তা বৈজ্ঞানিক সত্য নয় ।... বিজ্ঞান হচ্ছে পূর্বসৃষ্ট পদার্থের জ্ঞান। নূতন সৃষ্টির হিসাব। বিজ্ঞানের পাকা খাতায় পাওয়া যায় না। 

এই জ্ঞানের বিষয়টাই সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না। হতে পারে না এই জন্যই যে আঁকজোক মাপ-ওজনের পর এই জ্ঞানের বিবরণটাই হতে হয় একেবারে যথাযথ, Photographic বা যাকে রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন প্রকৃতির আশি—তাই। এই জ্ঞানের বিবরণটাই হচ্ছে নৈর্বক্তিক, এই জ্ঞানটাই কার্য-কারণ যুক্তি নির্ভর ও বুদ্ধিগ্রাহ্য, এটাকেই প্রমাণ করতে হয়। এটাকেই ভাষান্তরিত করা চলে এবং এই জ্ঞানটারই কোনো বিশেষ তত্ত্ব বা তথ্য একবার জানা হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার জানবার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তাছাড়া যে জ্ঞানের সূত্র প্রতিনিয়ত নতুন হচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে—সেও এই ফলিত বিজ্ঞানেরই তত্ত্ব। কারণ পূর্বসৃষ্ট পদার্থের আকজোক মাপ- এজন করার জ্ঞানকে মানুষ প্রতিনিয়তই নূতন সূত্রে ব্যাখ্যা করছে এবং করতে থাকবে। কোনোদিনই হয়তো বস্তুপদার্থের জ্ঞান মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করা সম্ভব হবে না। কিন্তু অপর দিকে যখন এই জ্ঞানের কথা আমরা কোনোখান থেকে উচ্চারিত হতে শুনি “ঈষা বাসামিদৎ সর্বং যৎ কিছু জাত্যাং জগৎ। (ঈশ ১/১) (ব্রহ্মান্ডে যা কিছু আছে সে সমস্তই সেই আত্মা থেকে অভিন্ন ঈশা পরম আত্মার দ্বারা আবরণীয়। শুনি—'এষ দেবা বিশ্বকর্মা মহাত্মা/সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ। হুদা মনীষা মনসাইভিক্লপ্ত: [শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ ৪ / ১৭ ] — যদি সর্বদাই সর্বজনের হৃদয়বাসী, সেই দেবতাই মহাত্মা এবং তিনি বিশ্বকর্মা। মনীষা ও মনের দ্বারা তিনি হৃদয়ে অভিব্যক্ত হন।

অথবা শুনি

                             এই স্তব্ধতায়

              শুনিতেছি তৃণে তৃণে ধুলায় ধূলায়

       মোর অঙ্গে রোমে রোমে লোকে-লোকান্তরে

              গ্রহে সূর্যে তারকায় নিত্য কাল ধরে

অণু পরমাণুদের নৃত্য কলরোল (নৈবেদ্য) তোমার আসন ঘেরি অনন্ত কল্লোল।"

তখন এই জ্ঞানের বিষয়কে প্রমাণ না করা গেলেও হৃদয়ে স্থাপন করা যায়, বুদ্ধিকে উদ্দীপিতও করা যায়। এই জ্ঞানের বিষয় অবশ্যই সাহিত্যের বিষয় হতে পারে এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও টলস্টয়ের মতে এই জ্ঞানের বিষয়ই হচ্ছে সাহিত্যের সর্বোত্তম বিষয়।

অনুরূপ ভাবে আলোচ্য প্রসঙ্গের ভাবের বিষয়টাও আমাদের যথোচিত স্পষ্টাস্পটিভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। কেননা, অধিকাংশ স্থলেই দেখেছি রবীন্দ্রনাথ কথিত এই 'ভাবের বিষয়টার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় আলোচকগণের কেউ রবীন্দ্রনাথের বাক্যগুলিকেই কিছু ভিন্ন চেহারার প্রতিশব্দের সমাবেশে paraphrase করে দিয়েছেন, অথবা কেউ 'ভাব'কে বলেছেন feeling বা হৃদয়ানুভূতি, আবার কেউ বলেছেন এই 'ভাব' হচ্ছে, সংস্কৃত আলংকারিকরা যাকে স্থায়ী ভার বলেছেন, তাই।

এর কোনোটিকেই রবীন্দ্রনাথ কথিত 'ভাবের' সঠিক ব্যাখ্যা বলে আমাদের মনে হয়নি। কারণ, প্যারাফ্রেজের অর্থ হচ্ছে বাক্যান্তর, ব্যাখ্যা নয়। Feeling ব্যাপারটা বৃহদংশেই মনের একটা শারীর ধর্ম মাত্র—সেটা ভাবের উদ্‌বেজক বা উদ্রেককারী হতে পারে, কিন্তু 'ভাব' নয়। আর সংস্কৃত আলংকারিকরা যে ব্যাপারটাকে ভাব বা স্থায়ীভাব রূপে আখ্যাত করেছেন সেটাও বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রেত অর্থের 'ভাব নয়। কারণ ডঃ সুশীল কুমার দে এবং অতুলচন্দ্র গুপ্তের মতে অলংকার শাস্ত্রের এই 'ভাব' নাকি ইংরেজি ভাষায় যাকে emotion বলা হয়, তাই। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর 'উত্তররাম চরিত'-এর আলোচনায় এই স্থায়ী ভাবকে বলেছেন passion, আবার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই emotion শব্দের বাংলা তর্জমা করেছেন, 'হৃদয়ের বৃত্তি, তাহা আমাদের হৃদয়ের আবেগ অর্থাৎ গতি / এবং বলেছেন, 'হৃদয়াকো সাহিত্যের একটা উপকরণ মাত্র, তাহা যে লক্ষ্য নহে এ-কথাটা এখনও ইংরেজি সাহিত্যে সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত হয় নাই ।—এই উত্তিদ্বয়ের সরলার্থ হল, emotion বা হৃদয়াবেগকে সাহিত্যের বিষয় বলে মেনে নিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই আদৌ সম্মত বা প্রস্তুত নন। তাহলে সাহিত্যের 'ভাব' মানে কী ?

আমাদের মনে হয়, এ প্রশ্নের জবাব আমরা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই কাছে সবচেয়ে নিখুঁত এবং সংশয়াতীত ৰূপে পাবো। কিন্তু সেটা আমাদের আহরণ করতে হবে তাঁর বিভিন্ন রচনা থেকে। কাজটা অবশ্যই অতিশয় দুরূহ এবং সুদীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ, যার উপযুক্ত অবকাশ বা পরিসর কোনোটাই এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। এই জন্য আপাতত আমরা সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের শুধু গুটিকয় যথা প্রসঙ্গ উক্তিই এখানে পেশ করবো, যা থেকে আমরা অর্থেরূপে উপলব্ধি করতে পারবো যে, রবীন্দ্রনাথ যে ভাবের বিষয়কে সাহিত্যের সামগ্রী হিসাবে বিশেষিত করেছেন সে 'ভাব' feelings নয়, হৃদয়াবেগ বা ইমোশনও নয়, তা হচ্ছে পুরোপুরি ভাবেই ম্যাথা আর্নল্ড কথিত সেই idea সেটা বস্তুবিশ্ব এবং সমকালীন সমাজ, ঐতিহ্য এবং প্রবহমান ইতিহাস এবং পূর্বসূরীদের রচনা ইত্যাদির সহিত সংযোগে এবং সংঘাতে লেখক নামক একজন মানুষের মনোলোকে তার নিজস্ব অভিজ্ঞাতা ও বোধের দ্বারা সৃষ্ট হয়।

এবারে প্রাসঙ্গিক বক্তব্যক-টির প্রতি একে একে দৃষ্টিপাত করা যাক : 

(১) 'ভাব প্রকাশ করিতে মানুষকেও নানা নৈপুণ্য প্রকাশ করিতে হয় । ... ভাব প্রকাশের জন্য পদ্যের আবশাক আছে কি না। .... ছোট ছেলেরা যেমন ছড়া ভালোবাসে তাহার ভাব মাধুর্যের জন্য নহে, কেবল তাহারা ছন্দোবদ্ধ ধ্বনির জন্য ..... আমাদের বয়ঃপ্রাপ্ত অংশ অর্থ চাহে, ভাব চাহে ; আমাদের অপরিণত অংশ ধ্বনি চাহে, ছন্দ চাহে—এখানে সরকটি 'ভাব'-এর অর্থ নয় মনোভাব নয় idea, বলাবাহুল্য, দুটো শব্দই সমার্থক। 

(২) ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা 'ছিন্ন পত্রাবলী'র অনেক চিঠিতেই তাঁর স্বরচিত বিভিন্ন কবিতা এবং অন্য কোনো কবিরও কোনো কোনো কবিতার ব্যাখ্যা ও আলোচনা প্রসঙ্গে কবি ভাব' শব্দটিকে এই idea অর্থেই বারবার ব্যবহার করেছেন। যেমন ৮০ নং চিঠিতে কামিনী সেনের কবিতা সম্বন্ধেও আমি এই কথা বলেছিলুম। তাঁর লেখায় বড় ভাব এবং নতুন ভাব ঢের থাকতে পারে, কিন্তু তাতে আগুন ধরে ওঠেনি। ১০৭ নং 'জাল ফেলা' কবিতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলছেন, 'এ কেবল কতকগুলি রঙিন ভাব মাত্র, তারও যে কোনোটার কী নাম, কী বিবরণ তারও ভালো পরিচয় পাওয়া যায় না । এই একই পত্রে 'মন্দির' কবিতা সম্বন্ধে বলছেন, 'উড়িষ্যার মন্দিরগুলো দেখে দেখে আমার এই রকম একটা ভাব এসে থাকবে।

(৩) 'জীবনস্মৃতি'তে ভাব অর্থে তিনি সরাসরিই idea শব্দটি ব্যবহার করেছেন। “প্রাকৃতিক পরিশোধের ভিতরকার ভাবটির একটি তত্ত্বব্যাখ্যা লিখিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। সীমা যে সীমাবদ্ধ নহে তাহা যে অতলস্পর্শ গভীরতাকে এক কণার মধ্যে সংহত করিয়া দেখাইতেছে, ইহা লইয়া আালোচনা করা হইয়াছে। তত্ত্ব হিসাবে সে ব্যাখ্যার কোনো মূলা আছে কিনা, এবং কাব্য হিসাবে 'প্রকৃতির পরিশোষ'-এর স্থান কী তাহা জানি না কিন্তু আজ দেখা যাইতেছে এই একটিমাত্র আইডিয়া অলক্ষ্যভাবে নানা দেশে আজ পর্যন্ত আমার সমস্ত রচনাকে অধিকার করিয়া আছে।

এই কটি দৃষ্টান্তই বোধ হয় আমাদের বক্তব্যের প্রামাণিকতার পক্ষে যথেষ্ট। লেখকের মনোলোকে জাত এই আইডিয়ার বীজ ছড়িয়ে থাকে তাঁর পরিবেশের সর্বত্র বস্তুবিশ্বে বা প্রকৃতিতে, তাঁর সমকালীন সমাজে, সেই সমাজের স্বকীয় ঐতিহ্যে, ইতিহাসের প্রবহমানতায়, কখনো বা লেখকের পূর্বসুরীদের রচনাতেও। এ সমস্তই বাইরের জিনিস, সকলের জিনিস, সাধারণের জিনিস। এদেরই সঙ্গে কখনো সংযোগের, কখনো সংঘাতে, কখনো আগ্রহ কখনো, কখনো আনন্দে, কখনো বেদনায়, কখনো ভীতিতে, কখনো বিস্ময়ে লেখকের নিজস্ব মনোলোকে, তাঁর ব্যক্তিগত বোধে ও অভিজ্ঞতায় তাঁর নিজস্ব আবো ও উপলব্ধির দ্বারা এই আইডিয়াগুলির জন্ম হয়, এবং তখন হয়তো। তাঁর এও মনে হয় -

                  এ কী দেখা দিলো আজ।

সে কি অসিত্বের সেই বিষাদ, যার তল মেলে না, সে কি সেই বোবার প্রশ্ন যার উত্তর লুকোচুরি করে রক্তে সে কি সেই বিরহ , যার ইতিহাস নেই। সে কি অজানা বাঁশির ডাকে অচেনা পথে স্বপ্নে চলা ঘুমের স্বচ্ছ আকাশতলে কোন নির্বাক রহস্যের সামনে ওকে নীরবে শুখিয়েছি কে তুমি ?

তোমার শেষ পরিচয় খুলে যাবে কোন লোকে [শ্যামলী/অকালঘুম এ হল লেখকের সকলের জিনিসকে, সাধারণ জিনিসকে নিজের করার প্রক্রিয়া। এই আইডিয়াকে ছবি ও সঙ্গীতে তানিত করে যখন লেখক বা আর্টিস্ট একটা আবার মাধ্যমের সেতু দিয়ে অন্যের মনে সংক্রামিত, সারিত করে দেন, তখনই জন্ম হয় সাহিত্যের এবং অন্যান্য যাবতীয় ললিতকলার। আর যে-শক্তিবলে লেখক তা করতে সক্ষম হন, সেটার নাম হল রচনাশক্তি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন সেটা একটা ব্যাখ্যাতীত ইন্দ্রজাল-সদৃশ ব্যাপার। তাছাড়া সেটা আমাদের উপস্থিত আলোচনার বিষয়ও নয়।

মোট কথা, লেখকের মনোলোকে এই আইডিয়ার জন্ম এবং এক-একটা মাধ্যমের আধারে তাদের প্রকাশ—এই সমস্ত ব্যাপারটাই যেন উদ্ভিদভের সন্ধ্যে বায়ুমণ্ডলম্ব অঙ্গার বা কার্বনের যে সম্পর্ক অনেকটা তারই মতো। কার্বন বস্তু বিশ্বের সর্বত্র ওতপ্রোতভাবে ছড়িয়ে আছে। উদ্ভিদ তাকে খাদ্যরূপে গ্রহণ করে নিজেকেও যেমন পৃষ্ঠ করে, তেমনই সঙ্গে সঙ্গে নিজের পুষ্টি-সম্পদ তার পাতা, ছায়া, ফুল, ফল এমনকি অনেক সময় নিজের দেহটাকেও অপরের ভোগের জন্য বিলিয়ে দেয়। সাহিত্যিক এবং আর্টিস্টও ঠিক তাই। পরিবেশ থেকে আহরিত আইডিয়া দিয়ে নিজের জীবনবোধকে যেমন ঋদ্ধ করেন, তেমনই সেই বোধের ঋন্দি দিয়ে পৃষ্ঠ করেন বিশ্বমানবের সংস্কৃতিকেও। 



প্রশ্ন। রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থ রূপে বাঁচিয়া থাকেন। ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে আলোচনা করো।


উত্তর : সাহিত্যের স্বরূপ, তার প্রকৃতি ও তাৎপর্য, তার বিষয় ও উপকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে এ পর্যন্ত * রবীন্দ্রনাথের নিকট আমরা যা যা শুনেছি তা থেকে সাহিত্যকে একনজরে চিনে নেওয়ার সে পরিচয়টি ইতিমধ্যে পাওয়া গিয়েছে, তা হচ্ছে মোটামুটিভাবে যথাক্রমে এই প্রকার।

(১) সাহিত্য পতন হল একটি প্রকাশ কর্ম।

(২) প্রকাশ কর্তা হচ্ছে মানুষের মন। এই মনের দুটি যমজ বা যুগ্ম ধর্মের যুগপৎ ক্রিয়াশীলতার মধ্য দিয়ে এই প্রকাশ কর্মটি সম্পন্ন হয়।

(৩) মানব মনের এই যমজ-ধর্ম দুটির প্রথমটির কাজ হচ্ছে বহিবৰ্গতে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানুষের আচরিত সর্বপ্রকার পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনাচারে পরিপার্শ্ব বা environment নামে যে ব্যাপারটি গড়ে উঠছে, তার সঙ্গে কখনো সংযোগ, কখনো আবার সংঘাতের মাধ্যমে মন নিজেরই অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত অপর একটি গৎ গড়ে তুলছে-যার ফলে সেই মনোজগতে অবিরত জেগে উঠছে, সৃষ্ট হচ্ছে অসংখ্য রকমের ভাবনা, স্বপ্ন, বক্তব্য ও আইডিয়া অথবা 'ভাব'।

(৪) এইভাবে মন একদিকে যেমন নিজের ভিতর ভাবনার গড়া এক নিজস্ব গড়ে তুলছে, সঙ্গে সঙ্গেই সেই যুগ স্বধর্মের তাড়নায় সেই ভাবনার জগৎটাকে প্রতিনিয়ত চাইছে অপরের মনে সঞ্চারিত ও সংক্রানিত করে দিতে। চাইছে কেবল তাৎক্ষণিক কৃতার্থতার জন্যই নয়, চাইছে এইভাবে সঞ্চারিত বা পুনর্জাত হয়ে অপর বহুসংখ্যক মনে বহুকাল সাধান হয়ে টিকে থাকার বাসনাতেও। 

(৫) কিন্তু প্রকাশ উন্মুখ হলেও মনের ভাবনাগুলি তো নিরবয়ব, বিমূর্ত। সেগুলিকে অন্যের হৃদয়ে চালান করার জন্য তাদের সাবয়ব বা মূর্ত করা যাবে কী করে? যিনি চিরী তিনি মনের ভাবনাকে অবয়ব দান করতে পারেন বিবিধ রঙ, রেখা ও রূপে রঞ্জিত তাঁর নিজের আঁকা ছবির পটে। যিনি ভাস্কর তিনি তা পারেন মূর্তি গড়ে সঙ্গীতশিল্পী পাবেন বিভিন্ন রাগ-রাগিণী নায়ক সুরের মায়াজাল রচনা করে। কিন্তু সাহিত্যিক ? তাঁর পুঁজি তো কেবল কতকগুলি শব্দ, words-স্বরূপের দিক থেকে সেগুলিও তো প্রায় প্রকাশ-উন্মুখ মনের ভাবনাগুলিরই মতো অবয়বহীন এবং বিমূর্ত। সাহিত্যিককে এই শব্দগুলি দিয়েই তাঁর ভাবনার ছবি আঁকতে হয়। আঁকেন উপমা ৰূপক ইত্যাদি অর্থালঙ্কারের সাহায্য নিয়ে, আর শব্দদের নিজেদেরই মধ্যে যে উচ্চারণযোগ্য ধ্বনি (sound) আছে, সেই ধ্বনিগুলিকে একটা বিশেষ আকারে বাজিয়ে তাদের মধ্যে সঙ্গীতের সমধর্মী একটা সুরের বেগ সৃষ্টি ক'রে।

"সাহিত্য" নামক ব্যাপারটির কাজ কারবারের মোটামুটি এই পরিচয় এ পর্যন্ত আমরা পেয়েছি।

কিন্তু এগুলিও তো হচ্ছে শুধু সাহিত্যের উপজীব্য ও উপাদান, বা তার নানান রকমের উপকরণ,সাজসরঞ্জাম বা মালমশলা মাত্র, এবং দ্রব্য হিসাবে এগুলির সবকটিই সর্বসাধারণের বেওয়ারিশ সম্পত্তি। এগুলিই তো সাহিত্য নয়। এগুলিকে যেমন তেমন করে একটা পাত্রের (form) মধ্যে জড়ো করলেই তা সাহিত্য হয়ে ওঠে না। সাহিত্য হচ্ছে পৃথক পৃথক ভাবে মাত্র একজন মানুষের এক-একটা অনন্য মনোগ্রাহী সৃষ্টি। সেই সৃষ্টিটা ঘটে কোন ঐজালিক প্রক্রিয়ায় ? এবারে সেই ব্যাপারটাই আমাদের জ্ঞাতব্য আমাদের উপস্থিত আলোচ্য প্রসাটিও তাই। এই প্রক্রিয়াটির নাম হচ্ছে লেখকের রচনাশক্তি বা নির্মাণ কৌশল, ইংরেজিতে যাকে বলে craftsman ship, style তবে জ্ঞাতব্য হলেও সাহিত্যের এই রচনাকৌশল বা স্টাইল বা ক্যাফটসম্যানশিপ।

ব্যাপারটা যে আসলে কী জিনিস সেটা কিন্তু আজো পর্যন্ত কেউই আমাদের সঠিক ভাবে জানাতে পারেননি।

আমাদের প্রাচীন আলংকারিকরা পারেননি। যদিও এটিকে নির্দেশিত বা বিশেষিত করতে তাঁরা কেউ এটিকে বলেছেন ভাষার প্রসাদগুণ, কেউ বলেছেন 'ধ্বনি' অর্থাৎ শব্দের বাচ্যার্থ অতিক্রম করে তার ব্যঞ্জনাশক্তি ; কেউ বলেছেন ওটা হচ্ছে অলংকার প্রয়োগের সৌকর্য। কিন্তু যে যাই বলুন, এরপর যখন প্রশ্ন হয়েছে বেছে বেছে এক-একজন বিশেষ মানুষেরই বা কেন এই গুণ বা কৃতিত্বটা আয়ত্তে আসে এবং কী উপায় অবলম্বন করে আসে; তখন তাঁরা বলেছেন ওটা হচ্ছে অপূর্ব-বস্তু-নির্মাণ ক্ষমা-প্রজ্ঞা অর্থাৎ যে বস্তু ইতিপূর্বে আর কেউ নির্মাণ করতে পারেননি সেই বস্তু নির্মাণের প্রজ্ঞা। তার মানে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝিয়ে বলার মতো নয়, চোখে আঙুল দিয়েও দেখাবার নয়—অথবা 'বুঝ লোকে যে জানো সন্ধান'। পাশ্চাত্য আলংকারিকগণও যে এ সম্বন্ধে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে সক্ষম হয়েছেন তেমন নিদর্শন অন্ততঃ তাঁদের রচনার মধ্যে নেই। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, এই রচনাকৌশলের আসল চাবিকাঠিটি হল রচনার unity বা সুমিতিতে। 'In the work of are each part should subserve the whole, while irrelevances, however brilliant in themselves, should be cast away’* ড্রাইডেন বলেছিলেন, ওটা হচ্ছে আসলে, এক রকম চারুলিখন—the best thoughts put in the best words in the best order । তারপর থেকে কত জনে কত কথাই বলেছেন। কেউ বলেছেন যেমন মানুষ তেমন স্টাইল – Style is the man - যত গভীর একজনের উপলব্ধি, তার প্রকাশও ততটাই পরিস্ফুট। অস্বচ্ছ ঘোলাটে মন থেকে আনন্দদায়ক প্রকাশ আবির্ভূত হতে পারে না। কেউ বলেছেন রচনাকৌশল মানে lucidity এবং clarity, সরলতা ও প্রাঞ্জলতা। কেউ বলেছেন এটা হচ্ছে sincerity বা আন্তরিকতা। আবার কেউ বলেছেন ওটা আসলে হচ্ছে সাহিত্যিকের sensuousness অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ানুভূতির সমকক্ষ তাঁরই একটা সুতীব্র প্রসূতি হৃদয়-বেদনা।

কিন্তু এইসব ধোঁয়াটে বা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোছের ব্যাখ্যার পরও কোনো নাছোড়বান্দা পাঠক যখন জানতে চেয়েছেন, কৃতী লেখকরা এইসব ব্যাপারগুলো তাঁদের রচনার দেহের মধ্যে প্রয়োগ করেন কীভাবে? তখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বহুবিচিত্র বাক্যজালে তাঁদের বক্তব্যের যে সারমর্মটি বেরিয়ে আসে সেটি আমাদের অলংকার শাস্ত্রীদের বক্তব্যেরই একটি ভিন্নতর পোশাক মাত্র। 'Here we touch on One of the supreme mysteris of literature. ' (Stephen Spenser - The Cirsis of Symbols) |

রচনা কৌশলের প্রকৃতি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই কথাটাই তাঁর বিভিন্ন রচনায় একাধিক অনুষঙ্গের সাহায্যে ব্যক্ত করে বলেছেন, সাহিত্যসৃষ্টির এ এক অলৌকিক রহস্য। অবশ্য 'সাহিত্য' পুস্তক এ বক্তব্যকে তিনি তত বিশদ করে বলেননি। শুধু ইতিপূর্বে একেবার বলেছিলেন, এই জিনিসটা হচ্ছে রমণীদেহের লাবণ্যের মতো। সেটা সুপরিমিত অ্যপ্রত্যতা সংস্থান জনিত রূপের অতিরিক্ত, অথচ তার দ্বারা মুগ্ধ হয়েও সেটা লাবণ্যকে আমরা রূপ থেকে বিশ্লিষ্ট করতে পারি না। আর এই প্রবন্ধে বলেছেন রচনাকৌশল হচ্ছে ভাবের দেহের মতো; এই দেহেই ভাবের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। এই কারণেই এটাকে জলের মতো পাত্রান্তর করা চলে না। এটা সাহিত্যেকের একেবারে সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃষ্টি। সাহিত্যিকার তাঁর এই রচনাকৌশলের প্রসাদেই পাঠকের হৃদয় হরণ করেন এবং বস্তুতপক্ষে এরই মধ্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকেন। অন্যত্র কিন্তু বিষয়টাকে তিনি আরও অনেক আগে আরও অনেক বিশদভাবে ব্যক্ত করেছিলেন।

প্রাসঙ্গিক বলেই সে বক্তব্যও আমাদের এখানে উপস্থিত করা উচিত। করছি : “আসল কবিত্ব জিনিসটি স্বতন্ত্র। কেবল ভাষার ক্ষমতা বলে নয়, গঠন করার শক্তি। একটা অলিখিত অচেতন নৈপুণ্যবলে ভাবগুলি কবির হাতে বিচিত্র আকার ধারণ করে। সেই সৃজনক্ষমতাই হচ্ছে কবিত্বের মূল।" [ছিন্নপত্রাবলী- ১০৭] “সেইটেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো ভারী শক্ত। কাঠও আছে, ফুঁও আছে—কেবল সেই স্ফুলিঙ্গটুকু নেই যাতে সবটা ধরে আগুন হয়ে ওঠে। এর মধ্যে কাঠের বোঝাটা নানা স্থান থেকে পরিশ্রমপূর্বক সংগ্রহ করে আনা যায়, কিন্তু অগ্নিকণাটুকু কবির নিজের অন্তরের মধ্যে আছে-সেটুকু না থাকলে পর্বত প্রমাণ স্তূপ বার্থ হয়ে যায় -01 আমাদের উপস্থিত আলোচনার সরকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নেরই উত্তর বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব এই উক্তি দুটিই মধ্যেই আছে, এবং কেন বিষয়েও নয়, ভাবেও নয়, লেখক যথার্থভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকেন শুধু তাঁর রচনাকৌশলেরই মধ্যে সেই প্রশ্নেরও উত্তর। এই প্রসঙ্গে দুটি প্রচণ্ড লাগসই দৃষ্টান্ত অতিশয় ভয়ে ভয়ে এখানে উপস্থিত করা যেতে পারে। ভয়ে ভয়ে কারণ, এ দৃষ্টান্তের যাথার্থ ভক্তিমার্গী অনেক পাঠকের মনঃপূত নাও হতে পারে। এখন নম্বর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ইংরেজি সাহিত্যের অস্কার ওয়াইল্ড (১৮৫৪-১৯০০) এপিগ্রামের রাজা, সাহিত্যে Dandyism অর্থাৎ ভাষা ও ফর্মের অতি পরিশীলিত চটকদারির সর্বপ্রথম প্রবন্ধা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, পত্রসাহিত্য, রম্য সাংবাদিকতা- সাহিত্যের এমন কোনো মাধ্যম নেই, যেখানে না তিনি স্বচ্ছন্দে এবং সদাপটে বিচরণ করেছেন, এবং তদ্বারা ইংরেজি ভাষাও পাঠকের হৃদয় হরণ করেছেন। কিন্তু এসবই তিনি করেছেন এবং করতে সক্ষম হয়েছেন, কেবলই তাঁর উই ও এপিগ্রামে সমুজ্জ্বল অনন্য রচনাকৌশল আর স্টাইলের দ্যুতিতে। Importance of Being Earnest' নামে তাঁর লেখা একটি প্রহসন জাতীয় কমেডি নাটক আজও পর্যন্ত লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের কোনো নাট্যমধ্যে অভিনীত হলে দর্শকের ভিড়ে প্রেক্ষাগৃহগুলি উপচে পড়ে। অথচ এই দুই দেশেরই শ্রদ্ধেয় নাট্যশাস্ত্রীরা এ-নাটকের শিল্পগুণ ওজন করতে গিয়ে বলেছেন-এ নাটকের প্লটের গাঁথুনিতে নাকি কোনো ঐক্য নেই, এর কেন্দ্রীয় থীম বা বক্তব্য নাকি রীতিমতো illogical যুক্তি বিবর্জিত : পাত্রপাত্রীদের চরিত্রায়ণ অমার্জনীয় রূপে অপরিণত, তাদের আচরিত সিচুয়েশন বা নাটা পরিস্থিতিগুলির মধ্যেও নাকি তেমন সুষম সংগতি নেই। তবু কেন এ নাটক আজও এমন জনপ্রিয় ? তার উত্তর রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই আমরা দিতে পারি। অনেক সময় কেবল ভাষার সৌকর্য, কেবল রচনার নৈপুণ্য মাত্র সাহিত্যে সমাদর পাইয়াছে। রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থ রূপে বাঁচিয়া থাকেন ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে। ওয়াইল্ডের অপ্রোল্লিখিত নাটকের ব্যাপারটিও ঠিক তাই। এর পাত্রপাত্রীদের সংলাপের বাকবৈদ্যই আজও এ নাটককে সমাদৃত করে রেখেছে।

দু নম্বর দৃষ্টান্ত, আমাদের ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র (১৭১২ – ১৭৬০ ) ।

মহৎ কবি বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ যার রচিত কাব্য মানুষকে কোনো মহনীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে অথবা মনুষ্য-চিত্তকে কোনো অনির্বচনীয় হৃদয়-সত্যের ইশারা দেয় সে রকম কবি ভারতচন্দ্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন নাগরিক কবি। তাঁর কাব্য যে অম্লীলতা দোষে দুষ্ট, তাদের বিষয়গত একমাত্র ঘনিষ্ঠ বয়স্যদের মজলিশ ব্যতীত অন্য কোথাও করা যায় না একথা তাঁর একালের পরমতত্ত্ব পাঠক ও পদাংক অনুসারী লেখক স্বয়ং প্রমথ চৌধুরী মশায়ও অস্বীকার করতে পারেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সঙ্গে সঙ্গে চৌধুরী মশায়ের একবাও না মেনে পারা যায় না যে, "Bharat Chandra, as a supreme literary craftsman, will ever remain a master to us, writers of the Bengali Language" t আজ দুশো বছর পরেও ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর পাঠ করে বিনোদিত হবেন না এমন পাঠক বোধ করি শুধু উচ্চণ্ড রকমের শুচিবাতিকগ্রস্ত কিছু নীতিবাগীশদের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। অন্যে পরে কা কথা, স্বয়ং বিদ্যাসাগরও ভারতচন্দ্রের একজন অনুরাগী পাঠক ছিলেন। মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্য পাঠের পরেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন, 'বেশ লিখেছো, খুব লিখেছো। কিন্তু ভারতচন্দ্রকে ছাড়াতে পারোনি।

এর কারণে, ভারতচন্দ্রের লেখায় আছে অসাধারণ প্রসাদগুণ আর ওয়াইল্ডের মতো অসামান্য উইট-ঝলকিত বাকচাতুর্য ও উজ্জ্বল হাস্যরস। তাঁর বিষয়ের জন্যও নয়, ভাবের জন্যও নয়, ভারত চন্দ্রতার এই অতুলনীয় রচনাকৌশল, তাঁর এই supreme literary craftsmanship-এর মধ্যেই অমর হয়ে আছেন।


Post a Comment

0 Comments